First posted on May 13, 2014 by sitardivine
আমদের গুরুভাই প্রনবদা সরকারী চাকরি করতেন, আমার সাথে খুব ভাব ছিল| উনি সরোদ বাজান| তখন উনি আফিস করতেন রাইটার্স বিল্ডিং এর পাঁচতলায়| আমি প্রায়ই কলেজ পালিয়ে ওঁর কাছে পৌঁছে যেতাম| তখন আমি বিদ্যাসাগর কলেজে ফিজিক্স নিয়ে যুদ্ধ করি|প্রণবদা আমার গান-বাজনার দুঃখ-কষ্টের ফিরিস্তি শুনতে শুনতে কখনই হাঁপিয়ে উঠতেননা| কত গৎ, কত রাগের আলোচনা যে রাইটার্সবিল্ডিং এ হয়েছে তার সাক্ষী প্রণবদার সেই টেবিল আর তার বাঁদিকের চেয়ারটি| ওস্তাদজীর কাছে তালীম, অন্য গাইয়ে বাজিয়েদের গান-বাজনা, এসব নিয়েই নানা প্রশ্ন আর তা নিয়ে, যাকে বলে, ফ্রিস্টাইল বাদানুবাদ| নিজেদের মধ্যেই প্রশ্ন তৈরী আর তা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক-বিতর্ক| আমাদের ওস্তাদজীর ছাত্র হওয়ার একটা স্পষ্ট অহঙ্কার ছিল| আমরা জানতাম যে আমরা যেমনটি খাস-তালীম পাচ্ছি তেমনটি দুর্লভ| আমরা জানি যে বাহার রাগের মন্দ্রতে কোমল ‘ণ’ লাগবে শুদ্ধ নয়| এ ধরনের খবর অন্য কোন বিশিষ্ট বাজিয়ের না জানা থাকার প্রমাণ পেলে বেশ খুশী হতাম| নানা সময়ে ওস্তাদজীর সাথে অন্য নামী শিল্পীর কথাবার্তার সময়ে কখনও কখনও কার্যকারণে উপস্থিত থেকেছি| মানে পড়ে একবার উনি ‘সৌরভ’ আফিসের দরজা থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, “সুনিয়ে, বহার কে মন্দ্র মেঁ কমল নিষাদ হী লগত হ্যাঁয়|” অন্য ওস্তাদটি বললেন, “জী, রাধুদা|” আমার চব্বিশ ইঞ্চি বুক ফুলে আঠাশ হয়ে গেল| বা কখনও, “আপনি কি রবিশংকর ঝেড়ে গান শেখান নাকি? যোগ কবে থেকে শুধু কমল নি-র রাগ হয়ে গেল?” সামনের বিশিষ্ট মানুষটি নিরুত্তর!
এবার আসল কথায় ফিরে আসি|কলকাতা রেডিও-র রেকর্ডিং সেরে সেতার নিয়ে যখন রাস্তায় বেরুলাম তখন দুপুর একটা| রাইটার্স এর দিকে নিজের থেকেই পা-টা চলতে শুরু করলো, বলাই বাহুল্য, প্রণবদার টানে| রাইটার্সের সিকিউরিটি নিয়ে কড়াকড়ি সেসময়ও ছিল, কিন্তু ফাঁকি দেবার রাস্তাও বেশ আয়ত্তে এসে গিয়েছিল| আমি ডালহৌসির ধবধবে সাদা চার্চের উল্টোদিকের লোহার গেট দিয়ে বেশিরভাগ দিন সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে ফুরুৎ করে গলে যেতাম| কখনও যে ধরা পড়িনি তা নয়| কপালদোষে ধরা পড়ে গেলে কাছেই অন্য একটা গেট দিয়ে ঢুকে একটা বড় টেবিল এর সামনে পৌঁছে যেতে হোত| সেখানে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার থাকতেন| সেখানেই গেটপাস যোগাড় করা হোত| সেদিন ওই গেটে পাহাড়া হালকা ছিল|অতএব সেতার নিয়ে বিনা বাঁধায় ঢুকে গেলাম| কিছুটা এগিয়েই রাইটার্সের সাবেকি লিফট, লাইনে দাড়ালাম| লিফট ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল, এরপর লিফটে ওঠার পালা| প্রায় চড়তেই যাব, হঠাৎ কোথা থেকে কে জানে এক রিভলবারধারী পুলিশ অফিসার আবির্ভূত হলেন| তিনি ত আমাকে দেখেই আটকে দিলেন, “আপনার গেটপাস?” আমি আর কি বলব, আমি ত গেটপাস বানাইনি| উনি বললেন, “আপনি আমার সাথে আসুন|” বুঝলাম গ্রেফতার হয়ে গেলাম| প্রণবদা তখনই কোন কারণে নিচে নেমেছিলেন, আমরা ওঁর চোখে পড়ে গেলাম| প্রণবদা প্রায় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলেন, “What happened, what happened?” আমায় পুলিশে ধরেছে দেখে বোধকরি টেনসনে ওঁর মুখ দিয়ে ইংরেজী বেরিয়ে এল| উনি নিজের আই-কার্ড দেখিয়ে অনেক বোঝানর চেষ্টা করলেন যে আমি ওনার কাছেই যাচ্ছিলাম; কিন্তু ভবি ভোলবার নয়| পুলিশ অফিসারটি প্রণবদার কথায় কানই দিলেননা| প্রণবদা বুঝলেন যে, “বাত বিগড় গয়ী|” শেষমেষ কোন উপায় না দেখে উনি বললেন, “তাহলে আমিও আপনাদের সাথে আসতে চাই|” অফিসারটি আপত্তি করলেননা| আমি প্রথমে কেমন যেন ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলাম, প্রণবদা সঙ্গে থাকায় বুকে কিছুটা বল পেলাম| লিফটটা ক্যাচর ক্যাচর আওয়াজ করতে করতে ধীরে ধীরে সবথেকে অপরের তলায় পৌঁছে গেল| আমরা সবাই চুপচাপ, কোন কথা নেই|
লিফট থেকে নেমে একটা বড় সবুজ দরজার সামনে আমাদের দাঁড় কারণ হ’ল| দেখলাম দরজায় একটা পেল্লাই সাইজের তালা ঝুলছে| অফিসারের পকেট থেকে চাবির গুচ্ছা বেরোল, ভাবলাম এই বুঝি জেলের দরজা| উনি তালা খুলে বললেন, “চলে আসুন|” ভেতরে ঢুকে লম্বা বারান্দা আর বাঁদিকে সুবিশাল সুসজ্জিত দেয়াল থেকে দেয়াল দামী কার্পেট এ মোড়া বসার ঘর| আরে, এ কোথায় এলাম! উনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি সত্যি সত্যি সেতার বাজাতে পারেন?” আমি বললাম, “আলবৎ পারি| বাজিয়ে শোনাব?” তারপর ওই পার্শিয়ান কার্পেটের ওপর সেতার খুলে বসে গেলাম| দেখি অফিসার সাহেব-ও দেরাজ খুলে কি যেন বের করার চেষ্টা করছেন| দেখলাম সেখান থেকে তামার বাঁয়া আর তবলা বেরুল আর তা কার্পেটের ওপর স্থাপিত হ’ল| অফিসার সাহেব তবলা নিয়ে বসলেন, ওই ভীতিকর আগ্নেয়াস্ত্রটি কোমরবন্ধ থেকে আলাদা হয়ে কার্পেটে অবস্থিত হোল| আরে, ইনি তবলা বাজান! আমি তো অবাক, প্রণবদাও তথৈবচ| বাজনা শুরু হোল| দারুন সঙ্গত করলেন দীপকবাবু, যাকে বলে খুব ভালো| এটা একেবারে ভাবাই যাচ্ছিলনা| আমরা প্রায় ঘন্টাখানেক গান-বাজনা করলাম| দীপক রায় কেরামত খাঁ সাহেবের গান্ডাবন্ধ শাগীর্দ| ওনাদের বাড়িতে মসিদ খাঁ সাহেবের ও যাতায়াত ছিল| দীপকবাবু আমার বাজনা শুনে খুব খুশী হলেন, রাইটার্স থেকে বেরিয়ে আমাকে ট্যাক্সিও ধরিয়ে দিলেন| দীপকবাবুর রিভালবারের দিকে তাকিয়ে ট্যাক্সিওয়ালা আর ‘যাব না’ বলতে পারলনা|