ঔরঙ্গাবাদের ছাতে

First Posted on May 16, 2014 by sitardivine

তখন বোধ হয় ১৯৮৩ বা ৮৪ সন| অল ইন্ডিয়া রেডিও সেসময় সারা দেশ জুড়ে অনেক ‘চেইন প্রোগ্রাম’ করত| এই চেইন প্রোগ্রাম-এ সাধারনতঃ দুজন শিল্পী বেশ কয়েকটা রেডিও স্টেশনে যেতেন আর সেখানে নিমন্ত্রিত শ্রোতাদের সামনে অনুষ্ঠান ও ষ্টুডিও রেকর্ডিং করতেন| তবলা, সারেঙ্গী, তানপুরা ইত্যাদি বাজানোর জন্য আলাদা করে শিল্পীর ব্যবস্থা হোত| এসময়টা বোধ করি ৮০-র দশকের মাঝামাঝি হবে| এটা আমার দ্বিতীয় ‘রেডিও চেইন’, বেশ উত্তেজিত, চারটি রেডিও স্টেশনে পৌঁছে বাজাতে হবে; নাগপুর, জলগাঁও, ঔরঙ্গাবাদ ও পুণে| নাগপুর আর জলগাঁওতে চুটিয়ে বাজনা ও রেকর্ডিং হয়ে গেছে, এখন বাসে করে ঔরঙ্গাবাদ যাচ্ছি| আমার সাথে পণ্ডিত যশরাজজীর ছাত্র আহমেদাবাদের কৃষ্ণকান্ত পারিখও একসাথে সফর করছেন| উনি আগে সুখেন্দুবাবুর[1] কাছে গান শিখেছেন| এই চেইনে নিমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে ওঁর গান আমার বাজনা হচ্ছিল|

ঔরঙ্গাবাদে আমার কোন পরিচিত মানুষ ছিলনা| জলগাঁও থেকে বসে যেতে যেতে কৃষ্ণকান্তজী বললেন ওই শহরে ওঁর এক বিশেষ পরিচিত আছেন, ডাঃ ভবান মহাজন| খুব নাম করা সার্জন আর যশরাজজীর বিশেষ অন্তরঙ্গ বন্ধু| ওই ডাক্তারবাবুর কাছেই উনি প্রথম যেতে চান| আমি ভাবলাম, এ বেশ হ’ল| ঔরঙ্গাবাদ পৌঁছে সোজা ডাক্তারবাবুর বিশালাকায় বাড়ীতে আমরা সবাই গিয়ে হাজির হলাম| ওঁর সাথে পরিচয় হওয়ার পার বুঝলাম এতো একেবারে গানপাগল মানুষ| স্বাভাবিকভাবেই যশরাজজীর কথা বারবার এসে পড়ছিল| পন্ডিতজী এ বাড়িতে বহু গেয়েছেন, সে সব নানা ঘটনা| ওঠবার সময় ডাক্তারবাবুকে বললাম যে আমরা এখানে একদিন গান-বাজনা করলে কেমন হয়| উনি প্রস্তাবে খুশি হয়ে বললেন, “কিয়ুঁ নহীঁ? বিলকুল হো সকতা হ্যাঁয়|” কৃষ্ণকান্তজীর অনুরোধে উনি আমাদের জন্য হোটেল বক করে রেখেছিলেন, আমরা এখান থেকে সটান হোটেলে পৌঁছে গেলাম|

নাগপুর থেকে ঔরঙ্গাবাদ, এই কদিনের সফরে এক অদ্ভুত ঘটনা বহুবার ঘটেছে| এর কারণ বুঝে ওঠা বেশ মুস্কিল| কিছুদিন একসাথে কাটানর পর আমরা খেয়াল করলাম যে কৃষ্ণকান্তজী ভাবছেন আমি তা বাজিয়ে ফেলছি| আমি আর উনি অনেকটা সময় ই একসাথে কাটাতাম, যদিও হোটেল এ আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা ছিল| ওঁর সাথে ছেলে নীরজও ছিল| নীরজ তখন তৈরি হচ্ছে, বেশ গায়, সেও যশরাজজীর কাছে তালিম নেয়| ধরুন সকালে বিলাসখানী বাজাচ্ছি, কৃষ্ণকান্তজী বলে উঠলেন, “আরে বিলাসখানী? বঢ়িয়া, ম্যায় সোচ হী রহা থা|” অথবা, “আরে কিতনা অচ্ছা মাধ্যম লগা, ম্যায় সোচ হী রহা থা কী অব মাধ্যম লগ যায়|” হয়তো সাথেই বলে উঠলেন, ” কেয়া অচ্ছা সাজ মিলা হ্যাঁয়| অলগ অলগ স্বর জান করকে মিলানা আপনে কহাঁ সে সিখা? হমারে গুরুজী ভী এইসা হী মিলাতে হ্যাঁয়|” বলাই বাহুল্য, কৃষ্ণকান্তজী সুন্দর সুরে গাইতেন আর সুরে সুরমণ্ডল মেলাতেন| সা, প, ম, বা গ জ্যান করে মেলান বা দুটি অথবা তিনটি স্বর কে সামনে রেখে কোথা থেকে শিখলাম বা কবে শুরু করলাম মনে নেই, তবে যন্ত্র মেলানর ব্যাপারে পাপা খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন| পরে আমার গুরু পণ্ডিত বিমলেন্দু মুখার্জীর কাছেও অসাধারণ সব মেলানর রাস্তা শিখেছি|আর দারুন রাস্তা দেখিয়েছিলেন জগদীশজী[2]| সে ই হোক| আমাদের ঔরঙ্গাবাদ রেডিওর ষ্টুডিও রেকর্ডিং ও বিশেষ নিমন্ত্রিত শ্রোতাদের সামনে অনুষ্ঠান ভালোভাবে হয়ে গেল, এবার ডাক্তারবাবুর বাড়ির অনুষ্ঠান| বেশ মজায় দিন কাটছে| মাঝে টুক করে আমরা ইলোরা ঘুরে এসেছি|

সেদিন ডাক্তারবাবুর বাড়ি অনুষ্ঠান| রোদ পড়তেই হোটেল থেকে বেরিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে গেলাম| গিয়ে দেখি ছাতে গান-বাজনার ব্যবস্থা হয়েছে| ড‌‍ঃ মহাজন বললেন নীরজ প্রথমে গাইবে, পারে আমি আর শেষে কৃষ্ণকান্তজীর গান হবে|

নীরজ পুরিয়া-কল্যাণ গাইল| অর ঘন্টাখানেক গাওয়ার পর আমার পালা| কি ইয়েন মানে হোল আমি দরবারী ধরলাম| যদিও রাগটা গভীর রাতের, কিন্তু মনের চাওয়ায় সায় দিয়ে মাঝ-সন্ধ্যেতেই দরবারী শুরু করে দিলাম| বেশ জমে উঠল আলাপ-জোড়| হাতের থেকে খুলে সামনে রাখা ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই মালুম হ’ল অনেক্ষণ বাজিয়ে ফেলেছি| ডাক্তারবাবু আর কৃষ্ণকান্তজী সামনেই বসে ছিলেন, বললাম, “জলদি খতম কার দেতা হুঁ|” ডাক্তারবাবু বললেন, “আজ সির্ফ আপকো হী সুনেঙ্গে| আপ আরামসে বজাইয়ে|” কৃষ্ণকান্তজীও বলে উঠলেন, “আপ বহুত অচ্ছা বজা রহেঁ হ্যাঁয়| আজ ম্যাঁয় নহীঁ গাউঙ্গা, আজ সির্ফ আপকো হী সুননা হ্যাঁয়| এরপর আমার বাজনা চলতে লাগল| আলাপ-জোড় বাজিয়ে ঝাঁপতালে গৎ ধরলাম তারপর আড়ানাতে দ্রুত| আড়ানার তান দেওয়া গৎ সবাই খুব হৈ-হৈ করে শুনলেন| ঝালা দিয়ে এই পর্ব শেষ হোল| তবলায় কে ছিলেন মানে নেই, তবে খুব ভালো বাজিয়েছিলেন| উনি ঔরঙ্গাবাদেরই তবলিয়া| আড়ানার পর কিছু একটা হালকা চলে বাজানর পার ভৈরবীর ফরমাইশ এলো| ভৈরবীতে বেশ কিছুটা আওচার করে আমার দাদাগুরু উস্তাদ মহম্মদ আমীর খাঁ সাহেবের একটা বিলম্বিত গত ধরলাম| চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু সেতারের আওয়াজ আর নিচুস্বরে তবলার ঠেকা চলছে| কিরকম একটা লীন হওয়া পরিবেশ| বাজনা শেষ হোল| কিন্তু কোনো হাততালি নেই! শ্রোতারা সব প্রস্তর মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে আছেন; বসে আছেন তো বসেই আছেন! নড়াচড়ার লেশমাত্র নেই! আমি আস্তে আস্তে ওখানে বসেই সেতারে কাপড়ের কভার দুটো পরিয়ে নিলাম| কেউ তো দেখছি নড়ছেনই না! উঠে দাড়ালাম| এতে যেন সবাই সম্বিত ফিরে পেলেন, অল্প-অল্প করে নড়াচড়া শুরু হ’ল| অনেকেই কাছে এসে অভিবাদন করলেন আর ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন ভালো লেগেছে কিন্তু তেমন কোনও কথা নয়| সবাই কেমন যেন চুপ করে থাকাটাই পছন্দ করছেন, আওয়াজ করে ভালো লাগার পারশটা যেন ভাঙতে চাইছেননা|প্রায় মৌন থেকেই ধীরে ধীরে সবাই বিদায় নিলেন| এ ঘটনা এখানে শেষ নয়|

ডাক্তারবাবু ওঁর শালাবাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “ইনহোনে আপলোগোঁকো হোটেল পঁহুচা দেঙ্গে|” শালাবাবুর গাড়িতে যন্ত্রপাতি তোলা হোল, আমরা রওনা হলাম| পেছনের সাইট আমি আর কৃষ্ণকান্তজী, সামনে নীরজ আর গাড়ি চালাচ্ছেন শালাবাবু| আমরা অনুষ্ঠানের কথা আলোচনা করতে করতে চলতে লাগলাম| কিছুক্ষনের মধ্যেই হোটেল এসে গেল| আমরা বাজনাগুলো নামিয়ে শালাবাবুকে ধন্যবাদ দিয়ে হোটেলের গেটের দিকে পা বাড়ালাম| কৃষ্ণকান্তজী চোখে দেখতে পেতেননা, ওঁর সাথে ধীরে ধীরে হাঁটতে হোত| হোটেলের দরজায় পৌঁছুতে বেশ কিছুক্ষণ লাগল| ঢোকার সময় রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি শালাবাবুর গাড়িতে তখন দাঁড়িয়ে| আরে, গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল নাকি? নীরজকে বললাম, “আপ থোড়া পিতাজী কো লেকর চলিয়েঁ, ম্যায় দেখ কর আতা হুঁ, ক্যা হো গিয়া|গাড়ি তো খরাব নহীঁ হো গয়ী!” গাড়ির কাছে পৌঁছে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি শালাবাবু চুপচাপ স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন| জিজ্ঞেস করলাম,” গাড়ী মেঁ কুছ হো গিয়া ক্যায়া? সব ঠিক তো হ্যাঁয় না?” উনি আরও কিছুক্স্গান চুপ থেকে বললেন, “আপকা সিতার ইতনা অচ্ছা লগা, বতা নহীঁ সকতা| উসকা গুঁঞ্জ পুরা ভরা হুয়া হ্যাঁয়, একদমসে পিছা কর রহাঁ হ্যাঁয়| ভগবাণ আপকো সদা মদত করে, আপ খুব খুব অচ্ছা বজাতে চলে|” এর পর গাড়িটা হুস্ করে বেরিয়ে গেল|

[1] পণ্ডিত সুখেন্দু গোস্বামী

[2] প্রখ্যাত গাইয়ে পণ্ডিত জগদীশ প্রাসাদ

Posted in PerformancesZ-Spaceবাংলায় হিজিবিজি. Tags: . Bookmark the permalinkEdit

৬০ পেরিয়ে

৬০ পার করাটা অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আটকানো গেলনা| কুষ্ঠিতে ছিলনা তাও পৌঁছেই গেলাম|এগার বছর বয়সেই সটকে যাবার কথা ছিল, তার জায়গায় ষাট! অতএব এ পর্যন্ত ৪৯ বছর ফাউ| ফাউ সবারই ভালো লাগে, সত্যি বলতে কি আমারও অল্প অল্প লাগে| জন্মদিনের দুদিন আগে জানতে পারলাম আমার শ্রীমতীজী কিছু একটা ফাঁদছেন, টের পেলাম উনি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথেও কথাবার্তা বলছেন| ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে ওঠার পরই তাড়াতাড়ি ইউনিভার্সিটি থেকে ঘরে ফেরার ফরমান জারী হল|

বিকেল সাড়ে-চারটে নাগাদ বাড়ী ফিরে দেখি সাবির সেই বর্ধমান থেকে আমার আগেই হাজির| এরপর আস্তে আস্তে অন্যরাও হাজির হল| ত্রৈলী সেই হাওড়া থেকে সাবির এর পর-পরই চলে এল | একটু পর ঢুকল সুমেধা| এর মাঝে সাবির আর অনির্বান টুক করে গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে কিছু বিশালাকায় পাত্রে খাবার নিয়ে চলে এসেছে| নভনীল, বাড়ীতে শোকের পরিবেশ থাকা সত্তেও, অল্প সময়ের জন্য চলে এসেছিল| ওকে পেয়ে আমাদের খুব ভাল লেগেছিল| সন্ধে গড়িয়ে গেলে এল দীপঙ্কর, অনুশ্রী আর তাদের ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে| মাঝে বনুদি আর অঞ্জনদা| একটু রাত করেই দিলীপ আর সপরিবার পরিমল ঢুকল| সবশেষে এল সুজু, অরুন আর পুকলাই| ওরা যখন এলো তখন পার্টি বেশ জমজমাট| অনির্বাণ সরোদ নিয়ে বাজনার ঘরে বাজিয়ে চলেছে| মাঝের বড় ঘরে গান, হাসাহাসি, কবিতা| আর মা’র ঘরে অঞ্জনদা, বনুদি আর পরে জুড়ল আমার মেয়ে মিম্মাই| সেখানেও চলছে নানা মজার মজার গল্প-গুজব| আর অন্য ঘরগুলো? সেখানে ঢাই করা জিনিস-পত্র, প্রয়োজনে আমরা সেখানে গিয়ে কাজ করে বেরিয়ে আসছি| সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত খুশীর মেজাজ| শব্দ নানা ধরনের হলেও তাতে ঠোকাঠুকি নেই| চলুক না আলাদা স্কেলে সরোদ আর গান| গানের পেছনে মৃদু সরোদের আওয়াজ, কখনও বা রান্নাঘর থেকে বাসনের শব্দ, সব আওয়াজই যেন মিলেমিশে খুশীর ছবি এঁকে চলেছে| ওই ছবিই কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি এই ছোট্ট ভিডিও তে| পার্টি যখন শেষ হল তখন আমার গিন্নির জন্মদিন ১৭ সেপ্টেম্বর ছুঁয়ে পরের দিন সকাল দু’টো!

আমরা সবাই মিস করলাম সুবীর, কর্নজিত, আয়ুষ, রাজরূপা, সুহাস, বিট্টু আর কুশলকে| কেউ বা ষ্টুডিও-তে আটকা, কেউ বা সেদিনই বিদেশ পারি দিল, কেউ আছে দেশের বাইরে বা কারুর বাড়ীতে পুজো| আর মিস করেছি তরাই, দেবাশিস আর তুলুকে|

 ঐদিন তোলা অল্প কিছু ছবি এই ছোট্ট এলবামে রাখা রইল|