‘১৩ জুলাই ২০১৮ আমার মৃত্যুদিন’ – চিত্রগুপ্ত কি চটজলদি কিছু আপডেট করলেন?

First posted on July 22, 2018 by sitardivine

সমুদ্রে প্রচণ্ড ঢেউ, ডুবেই  যাচ্ছি,  শরীরটাকেও ধরে রাখা যাচ্ছেনা, স্রোত  টেনে নিয়ে যাচ্ছে ! পারের জেলেটিকে  আমার মেয়ে বল্ল,  একটু এগিয়ে গিয়ে  বাবাকে  বাঁচিয়ে নাও। “না দিদি, পারবোনা ।”

বেশ কিছুদিন  ধরেই  আমরা ভাবছিলাম  কোথাও  একটু বেড়িয়ে  এলে  কেমন হয়।   মেয়ের  বিয়ের  পর  আমাদের সবাই  মিলে কোথাও  যাওয়াই হয়নি। টিপাই-র বুক করা হেনরি আইল্যান্ড এর মনোরম অতিথিশালায় যখন পৌঁছুলাম তখন সন্ধ্যে হয় হয়। তারপর তো  জমজমাট পার্টি! শুতে শুতে বেশ অনেকটাই রাত হয়ে গেলো। ভোর পৌনে পাঁচটায়, তখন ও ঘুম পুরো হয়নি, ফোন বেজে উঠল;  “বীচে যাবে নাকি?”  মিম্মাইর ফোন। আমি  ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম, দুজন ড্রাইভারকেও  জাগানো হল। আমার গিন্নি বললেন, তাঁর তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগবে। মা আর রুশাই  অন্য ঘরে  ছিল। রুশাই এর ও ঘুম জরুরী। তাই, ওরা তিনজন রয়ে গেলো। আমরা পাঁচজন;  সতুদা, বৌদি, টিপাই, মিম্মাই আর আমি গাড়ী চেপে রওনা হয়ে গেলাম। গাড়ী পৌঁছে দিলো একটা বাঁশের সাঁকোর সামনে।

নীল-সাদা রং করা  বাঁশের সাঁকো পেরুতেই   সমুদ্রের আওয়াজ কানে এলো। মনটা খুশীতে ভরে গেলো, সমুদ্র যদিও তখনও  দেখা যাচ্ছেনা। রুশাইর পছন্দ আর আমার গিন্নীর সমর্থনে একটা দামী ফোন কিনেছিলাম। ওটি বেশ ভালো ছবি তোলেন আর পকেটেও সহজেই চলে আসেন, তাই এবার  আর ক্যামেরা বা আই-প্যাড নিয়ে যাইনি। হৈ-চৈ করে ছবি তুলতে থাকলাম। নিজে ছবি তুলি, আর নিজেই খুশি হই। মাঝে মাঝে তারিফ পাওয়ার জন্য, কখনো সতুদা বা কখনো বৌদিকে ছবিগুলো দেখাই। মিম্মাই আর টিপাই কে দেখিয়ে লাভ নেই, কারণ ওদের পকেটেও ওই  যন্ত্র বা ওর থেকেও  ভালো যন্ত্র আছে। যাই  হোক ,  শেষ পর্যন্ত  বীচে  পৌঁছে গেলাম। দেখলাম বেশ বড় বড় কয়েকটা  সাইনবোর্ড।অতো সুন্দরের  মাঝে  কেউ কি আর পড়াশুনো করে? হয়ত’  পড়লাম, কিন্তু কিছুই  মাথায় ঢুকলোনা।

সমুদ্রতটে পৌঁছে  দেখলাম সামনে  অল্প  একটু জল, ওটা পেরুলেই  চড়া, আর  তার পরই দিগন্তজোড়া সমুদ্র –  তাতে সূর্য উঠছে!  সমুদ্র যেন হাতছানি দিয়ে ডাকল, ‘চলে এসো’। আমরা  পাঁচজনেই ছপ-ছপ  করে  জল পেরিয়ে চরায় গিয়ে   উঠলাম।  মনটা ভরে গেলো। সতুদা আর টিপাই আরও এগিয়ে সমুদ্রের জলে পা ভেজাল।  আমি আসার আগে ইন্টারনেট এ  হেনরি আইল্যান্ড সম্বন্ধে কিছুটা পড়েছিলাম। জেনেছিলাম, ওখানে চোরাবালি আছে। বাচ্চাদের মনের জোর অনেক বেশী, রুশাই কে বলাতে ও মুচকি হেসেছিল, হয়ত মনে মনে বলেছিল ‘বাবাইটাকে নিয়ে আর পারা যায়না’।  যাই হোক আমি নিজে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে চলছিলাম, যাতে  বালি নরম পেলেই টের পাই। দেখলাম সমুদ্রের কাছে সহজেই পোঁছে গেলাম। আনন্দ  আর ধরেনা। ছবির পর  ছবি তুলতে শুরু করলাম। সতুদা নানা পোজ দিয়ে  ছবি তুলল, একটা ছবি আবার বৌদিকে আধ-জড়িয়ে। টিপাই একদম ছবি তোলাতে চায়না। বৌদি বল্ল, ওর কয়েকটা ছবি তুলে দাও। দুর থেকে জুম করে যতটা  তোলা যায় তুললাম। কিন্তু ওভাবে কি আর ভালো ছবি হয়?  তখন ওকে বললাম, ‘এই  কাছে আয়, তোর সাথে দু-একটা সেলফি  তুলি। ও আপত্তি করলনা। স্ক্রিন এ ওর বাবা-মা আসছিল, বল্ল, তাড়াতাড়ি তোল, ওঁরাও ছবিতে চলে আসুক। সতুদাকে ফ্রেমে ধরা গেলনা, কিন্তু বৌদিকে ধরতে পারলাম।

তাখন সমুদ্র অল্প অল্প করে বাড়তে শুরু করেছে। টিপাই আর মিম্মাই সকালের প্রয়োজনে  আমাদের ছেড়ে আবার ওই ছপ-ছপ করে জল পেরিয়ে চলে গেলো। আমার বুড়ো-বুড়ীরা  তখন চরাতে হইচই করছি।  কিছুক্ষণ চলার পড় মনে হল এখন ফেরা যাক।

সমুদ্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখি মিম্মাই আর তার মা তটে  চলে  এসেছে। তখনই টের পেলাম সমুদ্র বেশ তাড়াতাড়ি  উথাল পাথাল করতে শুরু করেছে। সতুদা কে ডাকলাম, ‘তাড়াতাড়ি চলে আয়’। ও বোধ হয় ঠিক বুঝতে পারলনা। আমি ফেরার জন্যে হাঁটতে শুরু করেছি, সাথে বৌদি, সতুদা বেশ কিছুটা দুরে। আমি আর বৌদি তখন চেঁচাতে শুরু করেছি, ‘তাড়াতাড়ি এসো’, ‘তাড়াতাড়ি আয়’।

চরার শেষ প্রান্তে এসে দেখি, সেই অল্প জল প্রায় চারগুণ চওড়া হয়ে গেছে। কোথা দিয়ে যে ফিরব  ঠিক করতে সময় লাগছে। মিম্মাই বল্ল,  ‘ওদিক দিয়ে এসো’, ওদিকটা কিছুটা কম  চওড়া। ওই প্রান্তে গিয়ে দেখছি পার ভাঙতে শুরু করেছে। তখনই বুঝলাম,  যত দেরী হবে ততই তীরে  পৌঁছোতে পারার সম্ভাবনা  কমতে থাকবে। তখনও সতুদা বেশ কিছুটা দুরে।  অবস্থার ভয়াবহতা তখনো ও জানেনা। যাই হোক। নেমেই দেখলাম হাঁটু জল, জলে বেশ তোড়। হাঁটতে  শুরু করলাম,  যতটা তাড়াতাড়ি ওই স্রোতে হাঁটতে পারি। যতই সামনে এগুচ্ছি জল বাড়ছে, হাঁটু থেকে বুক, বুক থেকে গলা, তারপর তারও  ওপরে। মুখে নোনা জল ঢুকে যাচ্ছে, আর পা পাচ্ছিনা। ছোটবেলায়  ঢাকুরিয়াতে ‘ডগস ক্রল’ শিখেছিলাম, চেষ্টা করলাম, তেমন কোন কাজে এলনা। সমুদ্র তখন এই ভারী শরীরটাকেও ভাসিয়ে দুরে নিয়ে যাচ্ছে। যখন মাথা উঠল, তখন জেলেটিকে বললাম সাহায্য করতে, সে স্পষ্ট ‘না’ বলে দিলো। আমি মিম্মাই কে বললাম ‘তুই দৌড়ো’। গিন্নিকেও দেখলাম, সে অনেকটা দুরে। আমি বেশ তাড়াতাড়ি স্রোতের তোড়ে  সরে সরে যাচ্ছিলাম যে, ক্রস কারেন্টে খুব তাড়াতাড়ি পায়ের নিচের বালি সরে যাচ্ছিল। সেইসময় জেলেটি বল্ল, ‘বসে পরুন’। আমি হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে পড়লাম, শরীরটা যতটা উঁচু রাখা যায় সেভাবে। তাতে আমার বয়ে যাওয়াটা আটকাল। তখন সমুদ্রের বড়  ঢেউটা ফিরে গেছে আর নতুন ঢেউ তৈরি হচ্ছে। আমার গলা অবধি জল, বসে আছি। মিম্মাই তাখন জলে নেমে এসেছে। ও বলছে, ‘বাবাই,  দাঁড়িয়ে পড়’। আমি দাঁড়াব কি, তখনও ওখানে যা তোড়, দাঁড়ালেই তো  ভেসে যাব! মিম্মাইর যখন হাত বাড়াতে বাড়াতে আমার হাত অবধি পৌঁছুল, তখন ওরও হাঁটুর ওপরে জল। ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে যত তাড়াতাড়ি পারি জল ভেঙ্গে পারে এলাম।

পারে এসে দেখি সতুদা আর বৌদি তখনও চরাতে। ওদের গল্প আরও অনেক অনেক বেশী ভয়ঙ্কর। সে গল্প আরেকদিন বলব। শুধু এইটুকুই বলে রাখি, ওরাও  চিত্রগুপ্তের খাতায়  নতুন করে নাম লিখিয়েছে।

গ্যাংটক২২ জুলাই ২০১৮

—–

কোন ছবি দিতে পারলাম না। আমি যদিও  প্রাণ পেয়েছি,  কিন্তু  আমার  ফোনটি  বঙ্গোপসাগরের  জলে দেহ  রেখেছে।