জাদু ছিল ওই দরজা পেরিয়ে…

হোয়াটস-অ্যাপের ফ্যামিলি গ্রুপে রাতুর এত সুন্দর লেখা পড়ে আমারও কেমন যেন বেশ লেখা-লেখা পাচ্ছে। এটা অনেকটা সেই খোঁড়ার অলিম্পিক দৌড়নোর ইচ্ছের মত। খোঁড়া বলে কি কিছুই করব না? অলিম্পিক না দৌড়োই, আট-দশ পা হাঁটার চেষ্টা করতে আপত্তি কোথায়?

এই তো সেদিনের কথা। তখন আমি কিছুটা ছোট সাইজের ছিলাম, আরে না না, পাড়ার হুলো বেড়ালটার থেকে বেশ কিছুটা বড়ই ছিলাম। সে কি, এতে হাসার কী আছে? মানুষকে এরকম টাক-মাথারই থাকতে হবে এরকম কোন মাথার দিব্যি আছে নাকি? বিশ্বাস কর বা না কর তখন আমার মাথা ভর্তি চুল ছিল আর ভুঁড়ি একেবারেই ছিলনা।

যাদবপুরে আমার এক স্বপ্নপুরী ছিল। হ্যাঁ, ওই সেই সাদা গোল বাড়িটা, আর তার ব্রাউন রঙের দরজা, একটা গোল হাতল যেটা ঘোরালেই দরজা খুলে যেত, আর সেই দরজার ওপরে পিতলের ফলকে লেখা 37/5 জ্বল-জ্বল করত। বাড়ীর সামনে এক-ফালি জমি, তাতে কিছুটা বাগান, জমি পেরিয়ে লাল সিমেন্টে সবুজ বর্ডার দেওয়া বারান্দা। জাদু ছিল ওই দরজা পেরিয়ে।

দরজা পেরিয়ে ছোট্ট একটা ঘর, এ ঘরের চেহারা মাঝে মাঝেই বদলাত। কখন তাতে পড়ার টেবিল, কখন বসার জায়গা, কখনো খালি, কখন মোটর-সাইকেল, কখন কোন সকালে টেবিলের ওপর চেয়ার চড়িয়ে তার ওপর ছোট্ট দাদার গ্যাঁট হয়ে বসে মহারাজ হয়ে যাওয়া, বা দেখিয়ে দেখিয়ে মজা করে অল্প অল্প নুন খেতে খেতে ছোড়দির গুন-গুন করে গান গাওয়া। জিজ্ঞেস করলাম, “কি খাচ্ছিস রে?” উত্তর এলো “খাবি?” বললাম, “হ্যাঁ”। “তাহলে চোখ বন্ধ করে হা কর।“ তার পর মুখে এক মুঠো নুন ঠুসে দেওয়া — হা হা হা হা হা।      

সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় ৽ কলকাতা ৽ ২৮শে ফেব্রুয়ারী ২০২৪      

বুড়ি ও বুড়ো

রচনা: কেমনামি বোকানি 

একটা ছিল বুড়ো, একটা ছিল বুড়ি। 

থুড়ি,  

একটা ছিল বুড়ি আর একটা ছিল বুড়ো,

একজন গাইত গান আর অন্যটা বাটত মুড়ো। 

দুটোই ছিল পাগল, একটা সেয়ানা আর একটা আস্ত, 

কে যে কোনটা সেটাই ধাঁধাঁ। 

ধাঁধাঁর  উত্তর কেউ বলেনা, 

বললে পরেই পড়বে হানা,

আরে না না না না। 

বুড়ো বুড়ির আড়ি হবে,

ভাববে তারা, 

আমার ঘাড়ে ওরটা কেন পড়ে?

আস্ত হই বা সেয়ানা, কার তাতে কি?

জমিয়ে থাকি এটাই বড়,

নইলেই বিপত্তি।   

কলকাতা | ১৫.০৯.২০২১

ক্ষেত ভরে যাবে শস্যে

আমি জানি,

তোর ক্ষেত ভরে যাবে শস্যে,

সে বর্ষা নামুক বা না নামুক।

আমি জানি,

তোর কাছে আছে সেই চাবিকাঠি,

যাতে জল আছে, আছে প্রাণ।   

তোর জলের স্নেহে আসবে নতুন পাতা,

তরতরিয়ে উঠবে নতুন শাখা,

গুন গুনিয়ে আসবে ভোমরা

আসবে রঙিন প্রজাপতি

গাইবে পাখি, আসবে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে। 

তোর বাগান উঠবে মেতে,

সে বর্ষা নামুক বা  না নামুক।

কলকাতা, ০৭ অক্টোবর ২০২১

থাকব সবাই খোশ মেজাজে

লেখক – কেমনামি বোকানি

থাকব সবাই খোশ মেজাজে,  

হেসেই হব খান-খান,

খারাপ টাকে মারব ঘুষি 

বানাবো তাকে আন-বান।

থামব না কো কষ্ট পেয়ে 

রাখবনা ওই শব্দটা,

সময় আমার, বাঁচা আমার,  

রাঙিয়ে দেব আমার রঙে 

সাজবে নতুন আমার আপন জীবনটা। 

মনেই দুঃখ, মনেই সুখ, মনটা আমার। 

যে কেউ সেথায় পড়বে ঢুকে, 

জায়গা তাকে দিতেই হবে,  

সময় তাকে দিতেই হবে, 

এমন নিয়ম কিসের নিয়ম?  

রাজ্য আমার, রাজা আমি, 

আমিই বুঝব কি দাম কার। 

থাকব সবাই খোশ মেজাজে 

হেসেই হব খান-খান,

খারাপ টাকে মারব ঘুষি,  

বানাবো তাকে আন-বান।

কলকাতা | অক্টোবর ০৫, ২০২১ 

নিখুঁত আমি, আর সবেতে গণ্ডগোল!

লেখক – কেমনামি বোকানি*  

ভাবছিলাম আমি একজন দারুণ লেখক। আর মানুষ হিসেবে? এক্কেবারে, যাকে বলে নিখুঁত।  আরে আরে রেগে যাচ্ছেন কেন? ভাবতে কি অসুবিধে বলুন তো মশাই? এবার সত্যি কথাটা শুনুন, যখন লিখতে শুরু করলাম তখন আমার সব বিদ্যে-বুদ্ধি অসভ্যের মতন দাঁত বের করে  সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি তো লজ্জায় কুপোকাত! এতটা হরিদাস পাল নিজেকে কখনোই ভাবতে পারিনা।   

এবার ভণিতা ছেড়ে অন্য কথায় আসি। সেতো সাড়ে ছয় দশক পেরিয়ে প্রায় সাত দশক হতে চলল, আমার মতন দশাসই অকাজের মানুষের ওজন বয়ে চলতে ধরতী-মায়ের মুখে কোন রা নেই, অন্য দেবতারাও তেমন করে কোন আওয়াজ ওঠাচ্ছেন না। কিন্তু, সময় নিয়ে কিছুটা সমস্যা বোধ হচ্ছে। সময়টাকে সুন্দর করে তোলাটা যে যেমন-তেমন কাজ নয় সেটা সহজেই বুঝতে পারি। সময়টা সুযোগ পেলেই ব্রহ্মদত্যির মতন হুড়মুড় করে ঘাড়ে চেপে বসে ঘাড় মটকে দিতে  চায়, কিন্তু ওকে দিয়ে আদর করিয়ে নিতে গেলে বা সুন্দর গল্পে মন ভুলিয়ে নিতে গেলেই মহা-চাপ। 

কথাপ্রসঙ্গে বলি, এই ‘চাপ’  কথাটা আজকাল বেশ জমিয়ে চলছে। আজকের বাঙ্গালীদের জন্য ‘চাপ’ নিয়ে থিওরি কষার দরকার পড়েনা। কাকারা চাপে ও তাপে বেশ আছেন। কারুরই খুব একটা নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় নেই, অনেক মানুষই প্রায় নিঃস্বার্থভাবে অন্যের কি করা উচিত তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এতে, যারা ভাবছেন তাদের চাপ বাড়ে,বহু ক্ষেত্রে রক্তচাপও হয়ত বাড়ে। অনেকেই নিশ্চয় দুঃখিত হয়ে পড়েন যে তাদের এত ভাবা সত্যেও,  যাকে বা যাদের নিয়ে তারা চিন্তিত তাদের খুব একটা হেলদুল দেখতে পান না। বাংলায় এই ধরনের ঘটনাকেই বোধহয় বলে; “কবি এখানেই কেঁদেছেন”, এটি একটি বিশেষ বাগধারা বা লব্জ যাকে সোজা বাংলায় “বেঙ্গলী ইডিয়ম” বলা চলে।

কথা হচ্ছে, কবি না কাঁদলেও রাগ তো হতেই পারে। যারা সমাজসেবী তাদের কথা আলাদা, তাঁদের  জীবনই তো অন্যদের জন্যে উৎসর্গিত, আর এই ভাবনা তাঁদের সেবার অঙ্গ। যারা দেশ চালান বা দেশ চালানর কাজে যুক্ত হতে চান বা যে কোন অর্থে মানুষের সেবায় নিয়োজিত তাদের নিয়ে লিখছিনা, আমার লেখা এঁদের অতিরিক্ত মানুষজন নিয়ে। এই ধরনের মানুষজন অনেক বড় বড় ব্যপারের সাথে নিজেদের যুক্ত রাখেন, যেমন, কিউবার রাজনীতি বা দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি। তখনই ছোটখাটো বিষয়ে চিন্তা করেন যখন নিজে কোন কারণে আটকে পড়েন। এই অসুবিধেটা অন্য কারুর বা ত্রুটিপূর্ণ ব্যাবস্থার দোষে হয়েছে, এ বিষয়ে তাদের খুব একটা সন্দেহ থাকেনা। ওই মানুষটা যদি এমনটি  করতেন তাহলেই তো কাজটা হয়ে যেত অথবা বর্তমান দোষপূর্ণ ব্যবস্থাই সব গণ্ডগোলের জড়। আমি ব্যাপারটাকে সাপোর্ট করি। তাই তো বলি; নিখুঁত আমি, আর সবেতে গণ্ডগোল!  

*নামটা দুষ্টুমি করে বদলে দেওয়া। “কেমনামি বোকানি” আসলে ভুল নিয়মের বাংলা বাক্য, যেখানে কেমন+আমি=কেমনামি, আর ‘না’ কে ‘নি’ লেখা হয়েছে, বোকা + নি (না) = বোকানি; কেমনামি বোকানি –> কেমন আমি, বোকা না? আরে আরে, রেগে যাচ্ছেন কেন? পরশুরামের ভাষায়; “হয় হয়, zaনতি পারনা” [দক্ষিণ-চব্বিশ-পরগণা অঞ্চলে নকারাত্মক অর্থে ‘নি’ এর প্রয়োগের বহুলতা দেখে পাওয়া যায়। যেমন, যাবেনি? দেবেনি? ইত্যাদি। যদিও ‘বোকানি’ সেভাবে হয়ত প্রয়োগ হয়না।]       

লেখক সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন; “এ লেখাটা যদি ভাল লাগে তাহলে প্রশংসা আমাকেই করবেন। কিন্তু যদি পড়ে কিলোতে ইচ্ছে হয় তবে সে দায়িত্ব আমার নয়। সত্যি বলছি, ছোড়দি আর রাতু ভাল ভাল করেছে, তাই গ্যাস খেয়ে থাকতে না পেরে লেখাটা পাবলিক করে দিলাম। খারাপ লাগলে জানাবেন, ওদের ঠিকানা দিয়ে দেব।”

‘১৩ জুলাই ২০১৮ আমার মৃত্যুদিন’ – চিত্রগুপ্ত কি চটজলদি কিছু আপডেট করলেন?

First posted on July 22, 2018 by sitardivine

সমুদ্রে প্রচণ্ড ঢেউ, ডুবেই  যাচ্ছি,  শরীরটাকেও ধরে রাখা যাচ্ছেনা, স্রোত  টেনে নিয়ে যাচ্ছে ! পারের জেলেটিকে  আমার মেয়ে বল্ল,  একটু এগিয়ে গিয়ে  বাবাকে  বাঁচিয়ে নাও। “না দিদি, পারবোনা ।”

বেশ কিছুদিন  ধরেই  আমরা ভাবছিলাম  কোথাও  একটু বেড়িয়ে  এলে  কেমন হয়।   মেয়ের  বিয়ের  পর  আমাদের সবাই  মিলে কোথাও  যাওয়াই হয়নি। টিপাই-র বুক করা হেনরি আইল্যান্ড এর মনোরম অতিথিশালায় যখন পৌঁছুলাম তখন সন্ধ্যে হয় হয়। তারপর তো  জমজমাট পার্টি! শুতে শুতে বেশ অনেকটাই রাত হয়ে গেলো। ভোর পৌনে পাঁচটায়, তখন ও ঘুম পুরো হয়নি, ফোন বেজে উঠল;  “বীচে যাবে নাকি?”  মিম্মাইর ফোন। আমি  ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম, দুজন ড্রাইভারকেও  জাগানো হল। আমার গিন্নি বললেন, তাঁর তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগবে। মা আর রুশাই  অন্য ঘরে  ছিল। রুশাই এর ও ঘুম জরুরী। তাই, ওরা তিনজন রয়ে গেলো। আমরা পাঁচজন;  সতুদা, বৌদি, টিপাই, মিম্মাই আর আমি গাড়ী চেপে রওনা হয়ে গেলাম। গাড়ী পৌঁছে দিলো একটা বাঁশের সাঁকোর সামনে।

নীল-সাদা রং করা  বাঁশের সাঁকো পেরুতেই   সমুদ্রের আওয়াজ কানে এলো। মনটা খুশীতে ভরে গেলো, সমুদ্র যদিও তখনও  দেখা যাচ্ছেনা। রুশাইর পছন্দ আর আমার গিন্নীর সমর্থনে একটা দামী ফোন কিনেছিলাম। ওটি বেশ ভালো ছবি তোলেন আর পকেটেও সহজেই চলে আসেন, তাই এবার  আর ক্যামেরা বা আই-প্যাড নিয়ে যাইনি। হৈ-চৈ করে ছবি তুলতে থাকলাম। নিজে ছবি তুলি, আর নিজেই খুশি হই। মাঝে মাঝে তারিফ পাওয়ার জন্য, কখনো সতুদা বা কখনো বৌদিকে ছবিগুলো দেখাই। মিম্মাই আর টিপাই কে দেখিয়ে লাভ নেই, কারণ ওদের পকেটেও ওই  যন্ত্র বা ওর থেকেও  ভালো যন্ত্র আছে। যাই  হোক ,  শেষ পর্যন্ত  বীচে  পৌঁছে গেলাম। দেখলাম বেশ বড় বড় কয়েকটা  সাইনবোর্ড।অতো সুন্দরের  মাঝে  কেউ কি আর পড়াশুনো করে? হয়ত’  পড়লাম, কিন্তু কিছুই  মাথায় ঢুকলোনা।

সমুদ্রতটে পৌঁছে  দেখলাম সামনে  অল্প  একটু জল, ওটা পেরুলেই  চড়া, আর  তার পরই দিগন্তজোড়া সমুদ্র –  তাতে সূর্য উঠছে!  সমুদ্র যেন হাতছানি দিয়ে ডাকল, ‘চলে এসো’। আমরা  পাঁচজনেই ছপ-ছপ  করে  জল পেরিয়ে চরায় গিয়ে   উঠলাম।  মনটা ভরে গেলো। সতুদা আর টিপাই আরও এগিয়ে সমুদ্রের জলে পা ভেজাল।  আমি আসার আগে ইন্টারনেট এ  হেনরি আইল্যান্ড সম্বন্ধে কিছুটা পড়েছিলাম। জেনেছিলাম, ওখানে চোরাবালি আছে। বাচ্চাদের মনের জোর অনেক বেশী, রুশাই কে বলাতে ও মুচকি হেসেছিল, হয়ত মনে মনে বলেছিল ‘বাবাইটাকে নিয়ে আর পারা যায়না’।  যাই হোক আমি নিজে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে চলছিলাম, যাতে  বালি নরম পেলেই টের পাই। দেখলাম সমুদ্রের কাছে সহজেই পোঁছে গেলাম। আনন্দ  আর ধরেনা। ছবির পর  ছবি তুলতে শুরু করলাম। সতুদা নানা পোজ দিয়ে  ছবি তুলল, একটা ছবি আবার বৌদিকে আধ-জড়িয়ে। টিপাই একদম ছবি তোলাতে চায়না। বৌদি বল্ল, ওর কয়েকটা ছবি তুলে দাও। দুর থেকে জুম করে যতটা  তোলা যায় তুললাম। কিন্তু ওভাবে কি আর ভালো ছবি হয়?  তখন ওকে বললাম, ‘এই  কাছে আয়, তোর সাথে দু-একটা সেলফি  তুলি। ও আপত্তি করলনা। স্ক্রিন এ ওর বাবা-মা আসছিল, বল্ল, তাড়াতাড়ি তোল, ওঁরাও ছবিতে চলে আসুক। সতুদাকে ফ্রেমে ধরা গেলনা, কিন্তু বৌদিকে ধরতে পারলাম।

তাখন সমুদ্র অল্প অল্প করে বাড়তে শুরু করেছে। টিপাই আর মিম্মাই সকালের প্রয়োজনে  আমাদের ছেড়ে আবার ওই ছপ-ছপ করে জল পেরিয়ে চলে গেলো। আমার বুড়ো-বুড়ীরা  তখন চরাতে হইচই করছি।  কিছুক্ষণ চলার পড় মনে হল এখন ফেরা যাক।

সমুদ্রের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখি মিম্মাই আর তার মা তটে  চলে  এসেছে। তখনই টের পেলাম সমুদ্র বেশ তাড়াতাড়ি  উথাল পাথাল করতে শুরু করেছে। সতুদা কে ডাকলাম, ‘তাড়াতাড়ি চলে আয়’। ও বোধ হয় ঠিক বুঝতে পারলনা। আমি ফেরার জন্যে হাঁটতে শুরু করেছি, সাথে বৌদি, সতুদা বেশ কিছুটা দুরে। আমি আর বৌদি তখন চেঁচাতে শুরু করেছি, ‘তাড়াতাড়ি এসো’, ‘তাড়াতাড়ি আয়’।

চরার শেষ প্রান্তে এসে দেখি, সেই অল্প জল প্রায় চারগুণ চওড়া হয়ে গেছে। কোথা দিয়ে যে ফিরব  ঠিক করতে সময় লাগছে। মিম্মাই বল্ল,  ‘ওদিক দিয়ে এসো’, ওদিকটা কিছুটা কম  চওড়া। ওই প্রান্তে গিয়ে দেখছি পার ভাঙতে শুরু করেছে। তখনই বুঝলাম,  যত দেরী হবে ততই তীরে  পৌঁছোতে পারার সম্ভাবনা  কমতে থাকবে। তখনও সতুদা বেশ কিছুটা দুরে।  অবস্থার ভয়াবহতা তখনো ও জানেনা। যাই হোক। নেমেই দেখলাম হাঁটু জল, জলে বেশ তোড়। হাঁটতে  শুরু করলাম,  যতটা তাড়াতাড়ি ওই স্রোতে হাঁটতে পারি। যতই সামনে এগুচ্ছি জল বাড়ছে, হাঁটু থেকে বুক, বুক থেকে গলা, তারপর তারও  ওপরে। মুখে নোনা জল ঢুকে যাচ্ছে, আর পা পাচ্ছিনা। ছোটবেলায়  ঢাকুরিয়াতে ‘ডগস ক্রল’ শিখেছিলাম, চেষ্টা করলাম, তেমন কোন কাজে এলনা। সমুদ্র তখন এই ভারী শরীরটাকেও ভাসিয়ে দুরে নিয়ে যাচ্ছে। যখন মাথা উঠল, তখন জেলেটিকে বললাম সাহায্য করতে, সে স্পষ্ট ‘না’ বলে দিলো। আমি মিম্মাই কে বললাম ‘তুই দৌড়ো’। গিন্নিকেও দেখলাম, সে অনেকটা দুরে। আমি বেশ তাড়াতাড়ি স্রোতের তোড়ে  সরে সরে যাচ্ছিলাম যে, ক্রস কারেন্টে খুব তাড়াতাড়ি পায়ের নিচের বালি সরে যাচ্ছিল। সেইসময় জেলেটি বল্ল, ‘বসে পরুন’। আমি হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে পড়লাম, শরীরটা যতটা উঁচু রাখা যায় সেভাবে। তাতে আমার বয়ে যাওয়াটা আটকাল। তখন সমুদ্রের বড়  ঢেউটা ফিরে গেছে আর নতুন ঢেউ তৈরি হচ্ছে। আমার গলা অবধি জল, বসে আছি। মিম্মাই তাখন জলে নেমে এসেছে। ও বলছে, ‘বাবাই,  দাঁড়িয়ে পড়’। আমি দাঁড়াব কি, তখনও ওখানে যা তোড়, দাঁড়ালেই তো  ভেসে যাব! মিম্মাইর যখন হাত বাড়াতে বাড়াতে আমার হাত অবধি পৌঁছুল, তখন ওরও হাঁটুর ওপরে জল। ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে যত তাড়াতাড়ি পারি জল ভেঙ্গে পারে এলাম।

পারে এসে দেখি সতুদা আর বৌদি তখনও চরাতে। ওদের গল্প আরও অনেক অনেক বেশী ভয়ঙ্কর। সে গল্প আরেকদিন বলব। শুধু এইটুকুই বলে রাখি, ওরাও  চিত্রগুপ্তের খাতায়  নতুন করে নাম লিখিয়েছে।

গ্যাংটক২২ জুলাই ২০১৮

—–

কোন ছবি দিতে পারলাম না। আমি যদিও  প্রাণ পেয়েছি,  কিন্তু  আমার  ফোনটি  বঙ্গোপসাগরের  জলে দেহ  রেখেছে।

সেতার, বেড়াল ও জেসপা

First posted on May 13, 2014 by sitardivine

তখন আমরা ২০ বিধান পল্লীর বাসাবাড়ীতে থাকি. ওখানে রেলগাড়ীর ডিব্বার মত সারি দেওয়া তিনটে ঘর ছিল, তারপর রান্নাঘর আর এছাড়া একটা ঘর একটু আলাদা, সেখানে আমি রেয়াজ করতাম| সেদিন পাপা বাড়িতে, আমিও সেতার নিয়ে মাঝের বড় ঘরে চলে এসেছি| পাপা খাটে শুয়ে আছেন আর আমি মেঝেতে বসে বাজাচ্ছি| সে সময় বেশ বেড়ালের উৎপাত ছিল, আর মনে হয় বেড়ালের পপুলেশনও বেশ বেশি ছিল| কারণ খুব স্পষ্ট| এখান আর অত ঘন ঘন বেড়াল চোখে পড়েনা| যদিও বেড়াল পরিসংখ্যান কোথাও তেমন করে দেখিনি, তবে এ কথা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে হলফ করে বলতে পারি| অন্য একটা সম্ভাব্য কারণ অবশ্য, বেড়াল সম্প্রদায়ের বুদ্ধি ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে| এ সম্পর্কে বেড়ালবিদ পন্ডিতেরা আরও ভাল বলতে পারবেন| আমি যে কথা বলতে চাইছিলাম তা হচ্ছে মাছ, দুধ ইত্যাদি বেড়ালের জিভে না পৌঁছে যাতে আমাদের জিভ স্পর্শ করে তারই জন্য আমাদের জানালার শিক্গুলোতে লোহার তার লাগান হয়েছিল| খুব যে ঘন তা নয়, তবে সাধারণ বেড়ালের সাইজ থেকে বেশ ছোট|

আমার কোনদিন সেতারি হয়ে ওঠার ব্যাপারে পাপার প্রবল সন্দেহ ছিল| বলতেন, “এত নরম হাতে সেতার কি বাজবে, ডা-রাই বাজাতে পারিসনা|” এছাড়াও গান-বাজনার লাইনে এপাশ-ওপাশ থেকে গুঁতো খেয়ে গান-বাজনা পেশাদারী সম্পর্কে ওঁর অনেক বিপরীত বক্তব্য ছিল| তবে শেখাতে কার্পন্য করেননি| একটু এপাশ ওপাশ হলেই ভুল ধরিয়ে দিতেন|

সেদিন রেয়াজ করছি, বেশ মন দিয়েই বাজাচ্ছিলাম|সেতারে জোরে ঠোক মেরে রা-রা বাজাতে বেশ ভাল লাগত| মনের খুশিতে হঠাৎ মেরে দিলাম জোরসে ঠোক, তারপরেই ঘটে গেল সে ভীষণ ব্যাপার| দেখি, কিছু একটা সাদা লম্বাকার জিনিস পিঠে ধাক্কা দিয়ে, সেতারে ধাক্কা মেরে তীব্র গতিতে জানালার ফোকর দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল| তাকিয়ে দেখি তারের একটা ফোকড় বেশ কিছুটা বড় হয়ে গেছে আর তার চারদিকে সাদা লোম| পাপাও হঠাৎআওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন| সব কান্ড বুঝে চিৎকার করে উঠলেন, “দেখছিস তোর বাজনার বহর, বেড়াল কিভাবে ভয় পেয়ে পালাচ্ছে? বেড়ালের যদি এই হয় তাহলে মানুষের কি হবে ভাবতে পারছিস?” আমি কিছুটা মুষড়ে পড়লেও বাজনা থামালামনা|

এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে| আমি তখন লম্বা সময় ধরে রেয়াজ করি| নানা জায়গায় বাজাতেও শুরু করেছি| সে সময় কালীবাড়ী লেন-এ ওস্তাদজীর বাড়ির পরের গলিতেই একটা টিউশনি পেয়ে গেলাম| ছাত্রের নাম ‘দোলন’| সে আমার থেকে বয়সে অনেকটা বড় হলেও তা কখনও বুঝতে দেয়নি| ছাত্র-শিক্ষক সম্বন্ধের যথেষ্ঠ সম্মান করত| ওকে আমি বলতাম ‘ছাত্র বাবু’| সেই ছাত্র বাবুর একটা পেল্লাই সাইজের ডোবারমেন কুকুর ছিল| নাম ছিল ‘জেসপা’| দারুন স্মার্ট| একদিন শেখাতে  পৌঁচেছি, দেখি জেসপার মেজাজ খুব গরম| খুব জোরে চেঁচিয়ে চলেছে| অনেক চেষ্টা করেও তাকে শান্ত করা যাচ্ছেনা| ছাত্র বাবু, তার স্ত্রী, সবাই অনেক চষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন| আমি ভাবলাম একটা পরীক্ষা করে দেখা যাক্| গুরুর নাম নিয়ে আমি সেতার হাতে তুলে হাল্কা করে আলাপ বাজাতে শুরু করলাম| অবাক কান্ড! কিছুক্ষনের মধ্যেই জেসপা-র চিৎকার কমে গেল, তারপর চুপ করে শুয়ে পড়ল| এ ত ম্যাজিক!! গুরুদের মুখরক্ষা হ’ল, অল্প হলেও আমার গুরুদের সেখান বিদ্যে কাজে লেগে গেল|

শোনা শুরু

First posted on May 13, 2014 by sitardivine

তখন আমি বেশ ছোট| অল্পদিনের মধ্যেই সব জামা-কাপড় কেমন যেন আঁটোসাঁটো হয়ে উঠত, জুতোর তো কথাই নেই| কাজেই, জুতো, পাতলুন, কামিজ সবই কেনা হোত দু-সাইজ বড় | দুর্গাপূজো এলেই এ-দোকান সে-দোকান, নানা রঙের জামা কাপড়ের ভীড়, আর তার মধ্যেই কয়েকটা পেয়ে যাওয়া, বেশ খুশী হতাম| পড়াশুনোর রোজকার চাপাচাপি থেকেও কিছুদিন রেহাই পেতাম| খুব ভালো লাগত প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে বাজতে থাকা মাইকের গান| তখন গ্রামোফোন এ গোল-গোল কালো চাকতি চালিয়ে গান বাজান হোত| ‘খোয়া খোয়া চাঁদ’, প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া, আই আই ইয়া করুঁ ম্যায় কেয়া সুকু সুকু’, আরও কত কি! বাড়ীতে এসব সুন্দর মিষ্টি গান শোনার ওপর কড়া সেন্সর ছিল|এসব নাকি খেলো গান, শুনলেই ছেলে বয়ে যাবে! জ্যাঠার বাড়িতে একটা ঢাউস রেডিওগ্রাম ছিল| সেখানে আটটা চাকতি চাপিয়ে দিলে একটার পর একটা বাজতে থাকত| সেখানে ফৈয়াঁজ খাঁন, আব্দুল করিম খাঁন, কেসরবাঈ, বড়ে গুলাম, ভীস্মদেব, তারাপদ বাবু, গওহরজান, জ্ঞান গোঁসাই, সুধীরলাল চলত|আমার কিন্তু ওই ‘খোয়া খোয়া চাঁদ’-ই বেশী ভাল লাগত|

আমরা তখন থাকি ৩৬বি বেচারাম চ্যাটার্জ্জী রোডের ভাড়াবাড়িতে তে| পারে সে বাড়ির নম্বর বদলে ২৮ হয়েছিল| বাড়ীতে একটা মাঝারি সাইজের মারফি রেডিও এল| কি যে আনন্দ হয়েছিল বলে বোঝান মুস্কিল| ভাবলাম এ বেশ ভাল হোল, মজা করে গান শোনা যাবে| কিন্তু পারে বুঝলাম ‘সে গুড়ে বালি’| সে কথাই বলছি শুনুন|

তখন সবে পূজো-প্যান্ডেলের ম্যারাপ বাঁধা শুরু হয়েছে|নতুন শরৎ এর রোদ্দুরে শুধু খুশী আর খুশী, ইস্কুল বন্ধ হবে হবে ভাব| সেদিন রবিবার, গেলাম পাশের বাড়ীর অমলদার কাছে| সেখানে গিয়ে দেখি সে মহানন্দে হিন্দি গান শুনছে, মানে ওই হিন্দী সিনেমার গান| আমি ত’ অবাক! অমলদাকে তো কেউ বকছেনা! আরও অবাক হলাম, রেডিওতে সেই মাইকের গানগুলোই বাজছে| আমার জানা স্টেশন থেকে এসব গান শোনা যেতনা| আমি তো শুধু সকালে আর রাতে ওই না-ভালো-লাগা গানবাজনা আর খবর শুনতে পেতাম| অমলদাকে সটান প্রশ্ন করলাম, “অমলদা, তুমি ওই মাইকের গানগুলো রেডিওতে কি করে শুনছ?” সোজা উত্তর এল, “আরে নতুন একটা স্টেশন হয়েছে ‘বিবিধ ভারতী’, সেখানেই শোনা যায়|” এটা বোধহয় ষাটের দশকের শুরুর দিকের কথা| দেখে আসলাম স্টেশন কি করে ধরা যায়| অমলদা বুঝিয়ে দিল, স্টেশন ধরার কাঁটা-টা এক্কেবাব্রে ডানদিকে নিয়ে গিয়ে অল্প-স্বল্প নাড়ালেই ‘বিবিধ ভারতী’|আমাকে আর পায় কে! আমি তো নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলাম|

সেসময় ‘বিবিধ ভারতী’ এখনকার মত সারাদিন ধরে চলতনা, তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হোল| দুপুর একটা নাগাদ রেডিও অন করে কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করতেই আমার সাধের স্টেশন এর নাগাল পেয়ে গেলাম| সে কি আনন্দ! গানের পার গান চলতে লাগল| সে-সময় পিসি আমাদের সাথেই থাকত| হঠাৎ পিসির গলা কানে এল, “এসব কি লারেলাপ্পা শোনা হইতাসে?” রেডিওর আওয়াজ কিছুটা কমিয়ে দিয়ে কথাটা শুনিনি শুনিনি করে রইলাম| কিছুক্ষণ পার পিসির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, “পোলাডা এক্কেরে অপগন্ড হইসে| বাপে রবিশঙ্করের ছাত্র আর পোলায় শোনে লারেলাপ্পা| দেইখ্যা আয়, তর সোট ভাই কিটু, হেয়ায় ক্যামন মাথা নাড়াইয়া নাড়াইয়া আব্দুল করিম শোনে …|” এরপর আর রেডিও শোনা চলেনা, অতএব বন্ধ করতেই হোল|

তখন আমার সাইজ পাড়ার হুলো বেড়ালটার থেকে খুব একটা বড় ছিলনা| রেডিও রাখার পরেও টেবিল-এ যা জায়গা থাকত তাতে আমি বেশ আরাম করে আসন-কেটে বসে যেতে পারতাম| পিসির ওই বকাটা মন থেকে কিছুতেই যাচ্ছিলনা| ওই গান কিটু শোনে!! তাহলে আমাকেও চেচ্টা করে দেখতে হবে| দুপুর একটা থেকে দেড়টা রেডিওতে খেয়াল ইত্যাদি বাজান হোত| আমিও ওইসময় রেডিও তারস্বরে চালিয়ে টেবিলে বসে মাথা নাড়াতে শুরু করতাম| পিসি কাছাকাছি থাকলে মাথা নাড়ানর গতি তীব্রতর হোত| খুব চাইতাম যে পিসি দেখুক, কিন্তু দেখত বলে মানে হতনা| আমার বেশ কিছুদিন মাথা নাড়িয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাবার পর একদিন দুপুরে পিসি খেতে খেতে বলল, “ইবার ইটারে বাড়ির পোলা মনো হয়| কি যে ছাই-ছাতা শোনন শুরু করসিলি…”

শুরুতে ভালো না লাগলেও শেষমেষ রাগ-তালের নেশাটা লেগেই গেল|

ফিরে দেখা

First posted on May 5, 2014 by sitardivine

জমাটি লেখা পড়তে ভালোবাসি, কিন্তু হঠাৎ করে লিখতে বসে যাব কখনো ভাবিনি|আসল কথাটা বলি শুনুন, সে সব বলতে গেলে অনেক কথা এসে ভীড় করে| বেশ ক’বছর হোল আমাদের পাড়ার অনুষ্ঠানের স্মারিকায় আমার একটা লেখা ছেপেছিল| বিপদের শুরু সেখান থেকেই| সত্যিটা হচ্ছে, লেখাটা আমি লিখিইনি! অবাক হলেন? সে কথা না হয় পরে কখন খোলসা করে বুঝিয়ে বলব| কিন্তু ঘটনা যেটা ঘটল তা হোল সেটি পড়ে অনেকেই, বাংলায় যাকে বলে, ইম্প্রেসড হয়ে গেলেন| তখন থেকে অনেকেই বলছেন কিছু লেখা বাংলায় লিখে ফেলতে| আমি লিখতে চাইনা, হাতের লেখা দেখলে কাকেরাও লজ্জা পায়| আমি টাইপ করি| এতদিনে বাংলায় লেখার, থুড়ি, টাইপ করার একটা যুতসই ব্যবস্থা করা গেল| অতএব লেখা শুরু|
সময় ব্যাপারটা গোলমেলে, মনে হয় অনেকটাই ভাবনার সাথে জড়ান| বেশ কয়েক বছরের পুরানো ঘটনা কখনো মনে হয় ‘এই তো সেদিন’ আবার কখনও কতদিন আগের|কিছু থাকে ঝকঝকে আর কিছু কেমন যেন ধুলো পড়ে ধুলোটে| আমি গান-বাজনাতে বেঁচেছি, এতেই জেগেছি, স্বপ্নে মজা করে শুনেছি| সেতারকে ভালবাসার অনেক ‘ট্যাক্সো’ আছে; দিয়েছি| এনাকে বোঝা আর বাগে আনার মধ্যে বিস্তর দুরত্ব| যদি বা কোনক্রমে কথা শুনতে শুরু করেন তারপর তাকে দিয়ে গল্প বলানো বা ছবি আঁকান, সে’ত যেনতেন কাজ নয়| আমি ভাবছিলাম সে-সব কথাই কিছুটা আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করব|
একটা ছোট্ট কথা বলে নিই| আমার চরিত্র চিরকালই কিছুটা বেয়াড়া ধরনের| ভক্তি-শ্রদ্ধা নিয়ে চিরকালই অভাব অনটন| সোজাসুজি মেনে নেওয়ার ক্ষমতাই ছিলনা, বোধহয় এটা কোন ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট| নিজের মত করে বুঝে নেবার একটা তীব্র প্রচেষ্টা, যাতে স্বাভাবিক কারণেই বয়স্কদের অসভ্য না ভাবার কোনো কারণ ছিলনা| কিন্তু কিচ্ছু অজানা কারণে এতসব অবগুণ থাকা সত্যেও সবাই সহ্য করতেন| একটা কারণ বোধহয় আমাকে বোঝাতে শেখাতে বড়দের তেমন কোন বেগ পেতে হতনা| ওস্তাদজী বলতেন, “ছোঁড়ার আর যাই থাক, না বোঝার ব্যামোটা নেই|”

ছায়াচিত্র : রাখী ব্যানার্জী০৭  মে ২০১৪

প্রণবদা ও পুলিশ

First posted on May 13, 2014 by sitardivine

আমদের গুরুভাই প্রনবদা সরকারী চাকরি করতেন, আমার সাথে খুব ভাব ছিল| উনি সরোদ বাজান| তখন উনি আফিস করতেন রাইটার্স বিল্ডিং এর পাঁচতলায়| আমি প্রায়ই কলেজ পালিয়ে ওঁর কাছে পৌঁছে যেতাম| তখন আমি বিদ্যাসাগর কলেজে ফিজিক্স নিয়ে যুদ্ধ করি|প্রণবদা আমার গান-বাজনার দুঃখ-কষ্টের ফিরিস্তি শুনতে শুনতে কখনই হাঁপিয়ে উঠতেননা| কত গৎ, কত রাগের আলোচনা যে রাইটার্সবিল্ডিং এ হয়েছে তার সাক্ষী প্রণবদার সেই টেবিল আর তার বাঁদিকের চেয়ারটি| ওস্তাদজীর কাছে তালীম, অন্য গাইয়ে বাজিয়েদের গান-বাজনা, এসব নিয়েই নানা প্রশ্ন আর তা নিয়ে, যাকে বলে, ফ্রিস্টাইল বাদানুবাদ| নিজেদের মধ্যেই প্রশ্ন তৈরী আর তা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক-বিতর্ক| আমাদের ওস্তাদজীর ছাত্র হওয়ার একটা স্পষ্ট অহঙ্কার ছিল| আমরা জানতাম যে আমরা যেমনটি খাস-তালীম পাচ্ছি তেমনটি দুর্লভ| আমরা জানি যে বাহার রাগের মন্দ্রতে কোমল ‘ণ’ লাগবে শুদ্ধ নয়| এ ধরনের খবর অন্য কোন বিশিষ্ট বাজিয়ের না জানা থাকার প্রমাণ পেলে বেশ খুশী হতাম| নানা সময়ে ওস্তাদজীর সাথে অন্য নামী শিল্পীর কথাবার্তার সময়ে কখনও কখনও কার্যকারণে উপস্থিত থেকেছি| মানে পড়ে একবার উনি ‘সৌরভ’ আফিসের দরজা থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, “সুনিয়ে, বহার কে মন্দ্র মেঁ কমল নিষাদ হী লগত হ্যাঁয়|” অন্য ওস্তাদটি বললেন, “জী, রাধুদা|” আমার চব্বিশ ইঞ্চি বুক ফুলে আঠাশ হয়ে গেল| বা কখনও, “আপনি কি রবিশংকর ঝেড়ে গান শেখান নাকি? যোগ কবে থেকে শুধু কমল নি-র রাগ হয়ে গেল?” সামনের বিশিষ্ট মানুষটি নিরুত্তর!

এবার আসল কথায় ফিরে আসি|কলকাতা রেডিও-র রেকর্ডিং সেরে সেতার নিয়ে যখন রাস্তায় বেরুলাম তখন দুপুর একটা| রাইটার্স এর দিকে নিজের থেকেই পা-টা চলতে শুরু করলো, বলাই বাহুল্য, প্রণবদার টানে| রাইটার্সের সিকিউরিটি নিয়ে কড়াকড়ি সেসময়ও ছিল, কিন্তু ফাঁকি দেবার রাস্তাও বেশ আয়ত্তে এসে গিয়েছিল| আমি ডালহৌসির ধবধবে সাদা চার্চের উল্টোদিকের লোহার গেট দিয়ে বেশিরভাগ দিন সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে ফুরুৎ করে গলে যেতাম| কখনও যে ধরা পড়িনি তা নয়| কপালদোষে ধরা পড়ে গেলে কাছেই অন্য একটা গেট দিয়ে ঢুকে একটা বড় টেবিল এর সামনে পৌঁছে যেতে হোত| সেখানে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার থাকতেন| সেখানেই গেটপাস যোগাড় করা হোত| সেদিন ওই গেটে পাহাড়া হালকা ছিল|অতএব সেতার নিয়ে বিনা বাঁধায় ঢুকে গেলাম| কিছুটা এগিয়েই রাইটার্সের সাবেকি লিফট, লাইনে দাড়ালাম| লিফট ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল, এরপর লিফটে ওঠার পালা| প্রায় চড়তেই যাব, হঠাৎ কোথা থেকে কে জানে এক রিভলবারধারী পুলিশ অফিসার আবির্ভূত হলেন| তিনি ত আমাকে দেখেই আটকে দিলেন, “আপনার গেটপাস?” আমি আর কি বলব, আমি ত গেটপাস বানাইনি| উনি বললেন, “আপনি আমার সাথে আসুন|” বুঝলাম গ্রেফতার হয়ে গেলাম| প্রণবদা তখনই কোন কারণে নিচে নেমেছিলেন, আমরা ওঁর চোখে পড়ে গেলাম| প্রণবদা প্রায় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলেন, “What happened, what happened?” আমায় পুলিশে ধরেছে দেখে বোধকরি টেনসনে ওঁর মুখ দিয়ে ইংরেজী বেরিয়ে এল| উনি নিজের আই-কার্ড দেখিয়ে অনেক বোঝানর চেষ্টা করলেন যে আমি ওনার কাছেই যাচ্ছিলাম; কিন্তু ভবি ভোলবার নয়| পুলিশ অফিসারটি প্রণবদার কথায় কানই দিলেননা| প্রণবদা বুঝলেন যে, “বাত বিগড় গয়ী|” শেষমেষ কোন উপায় না দেখে উনি বললেন, “তাহলে আমিও আপনাদের সাথে আসতে চাই|” অফিসারটি আপত্তি করলেননা| আমি প্রথমে কেমন যেন ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলাম, প্রণবদা সঙ্গে থাকায় বুকে কিছুটা বল পেলাম| লিফটটা ক্যাচর ক্যাচর আওয়াজ করতে করতে ধীরে ধীরে সবথেকে অপরের তলায় পৌঁছে গেল| আমরা সবাই চুপচাপ, কোন কথা নেই|

লিফট থেকে নেমে একটা বড় সবুজ দরজার সামনে আমাদের দাঁড় কারণ হ’ল| দেখলাম দরজায় একটা পেল্লাই সাইজের তালা ঝুলছে| অফিসারের পকেট থেকে চাবির গুচ্ছা বেরোল, ভাবলাম এই বুঝি জেলের দরজা| উনি তালা খুলে বললেন, “চলে আসুন|” ভেতরে ঢুকে লম্বা বারান্দা আর বাঁদিকে সুবিশাল সুসজ্জিত দেয়াল থেকে দেয়াল দামী কার্পেট এ মোড়া বসার ঘর| আরে, এ কোথায় এলাম! উনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি সত্যি সত্যি সেতার বাজাতে পারেন?” আমি বললাম, “আলবৎ পারি| বাজিয়ে শোনাব?” তারপর ওই পার্শিয়ান কার্পেটের ওপর সেতার খুলে বসে গেলাম| দেখি অফিসার সাহেব-ও দেরাজ খুলে কি যেন বের করার চেষ্টা করছেন| দেখলাম সেখান থেকে তামার বাঁয়া আর তবলা বেরুল আর তা কার্পেটের ওপর   স্থাপিত হ’ল| অফিসার সাহেব তবলা নিয়ে বসলেন, ওই ভীতিকর আগ্নেয়াস্ত্রটি কোমরবন্ধ থেকে আলাদা হয়ে কার্পেটে অবস্থিত হোল| আরে, ইনি তবলা বাজান! আমি তো অবাক, প্রণবদাও তথৈবচ| বাজনা শুরু হোল| দারুন সঙ্গত করলেন দীপকবাবু, যাকে বলে খুব ভালো| এটা একেবারে ভাবাই যাচ্ছিলনা| আমরা প্রায় ঘন্টাখানেক গান-বাজনা করলাম| দীপক রায় কেরামত খাঁ সাহেবের গান্ডাবন্ধ শাগীর্দ| ওনাদের বাড়িতে মসিদ খাঁ সাহেবের ও যাতায়াত ছিল| দীপকবাবু আমার বাজনা শুনে খুব খুশী হলেন, রাইটার্স থেকে বেরিয়ে আমাকে ট্যাক্সিও ধরিয়ে দিলেন| দীপকবাবুর রিভালবারের দিকে তাকিয়ে ট্যাক্সিওয়ালা আর ‘যাব না’ বলতে পারলনা|