শোনা শুরু

First posted on May 13, 2014 by sitardivine

তখন আমি বেশ ছোট| অল্পদিনের মধ্যেই সব জামা-কাপড় কেমন যেন আঁটোসাঁটো হয়ে উঠত, জুতোর তো কথাই নেই| কাজেই, জুতো, পাতলুন, কামিজ সবই কেনা হোত দু-সাইজ বড় | দুর্গাপূজো এলেই এ-দোকান সে-দোকান, নানা রঙের জামা কাপড়ের ভীড়, আর তার মধ্যেই কয়েকটা পেয়ে যাওয়া, বেশ খুশী হতাম| পড়াশুনোর রোজকার চাপাচাপি থেকেও কিছুদিন রেহাই পেতাম| খুব ভালো লাগত প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে বাজতে থাকা মাইকের গান| তখন গ্রামোফোন এ গোল-গোল কালো চাকতি চালিয়ে গান বাজান হোত| ‘খোয়া খোয়া চাঁদ’, প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া, আই আই ইয়া করুঁ ম্যায় কেয়া সুকু সুকু’, আরও কত কি! বাড়ীতে এসব সুন্দর মিষ্টি গান শোনার ওপর কড়া সেন্সর ছিল|এসব নাকি খেলো গান, শুনলেই ছেলে বয়ে যাবে! জ্যাঠার বাড়িতে একটা ঢাউস রেডিওগ্রাম ছিল| সেখানে আটটা চাকতি চাপিয়ে দিলে একটার পর একটা বাজতে থাকত| সেখানে ফৈয়াঁজ খাঁন, আব্দুল করিম খাঁন, কেসরবাঈ, বড়ে গুলাম, ভীস্মদেব, তারাপদ বাবু, গওহরজান, জ্ঞান গোঁসাই, সুধীরলাল চলত|আমার কিন্তু ওই ‘খোয়া খোয়া চাঁদ’-ই বেশী ভাল লাগত|

আমরা তখন থাকি ৩৬বি বেচারাম চ্যাটার্জ্জী রোডের ভাড়াবাড়িতে তে| পারে সে বাড়ির নম্বর বদলে ২৮ হয়েছিল| বাড়ীতে একটা মাঝারি সাইজের মারফি রেডিও এল| কি যে আনন্দ হয়েছিল বলে বোঝান মুস্কিল| ভাবলাম এ বেশ ভাল হোল, মজা করে গান শোনা যাবে| কিন্তু পারে বুঝলাম ‘সে গুড়ে বালি’| সে কথাই বলছি শুনুন|

তখন সবে পূজো-প্যান্ডেলের ম্যারাপ বাঁধা শুরু হয়েছে|নতুন শরৎ এর রোদ্দুরে শুধু খুশী আর খুশী, ইস্কুল বন্ধ হবে হবে ভাব| সেদিন রবিবার, গেলাম পাশের বাড়ীর অমলদার কাছে| সেখানে গিয়ে দেখি সে মহানন্দে হিন্দি গান শুনছে, মানে ওই হিন্দী সিনেমার গান| আমি ত’ অবাক! অমলদাকে তো কেউ বকছেনা! আরও অবাক হলাম, রেডিওতে সেই মাইকের গানগুলোই বাজছে| আমার জানা স্টেশন থেকে এসব গান শোনা যেতনা| আমি তো শুধু সকালে আর রাতে ওই না-ভালো-লাগা গানবাজনা আর খবর শুনতে পেতাম| অমলদাকে সটান প্রশ্ন করলাম, “অমলদা, তুমি ওই মাইকের গানগুলো রেডিওতে কি করে শুনছ?” সোজা উত্তর এল, “আরে নতুন একটা স্টেশন হয়েছে ‘বিবিধ ভারতী’, সেখানেই শোনা যায়|” এটা বোধহয় ষাটের দশকের শুরুর দিকের কথা| দেখে আসলাম স্টেশন কি করে ধরা যায়| অমলদা বুঝিয়ে দিল, স্টেশন ধরার কাঁটা-টা এক্কেবাব্রে ডানদিকে নিয়ে গিয়ে অল্প-স্বল্প নাড়ালেই ‘বিবিধ ভারতী’|আমাকে আর পায় কে! আমি তো নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলাম|

সেসময় ‘বিবিধ ভারতী’ এখনকার মত সারাদিন ধরে চলতনা, তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হোল| দুপুর একটা নাগাদ রেডিও অন করে কিছুক্ষণ খোঁজাখুজি করতেই আমার সাধের স্টেশন এর নাগাল পেয়ে গেলাম| সে কি আনন্দ! গানের পার গান চলতে লাগল| সে-সময় পিসি আমাদের সাথেই থাকত| হঠাৎ পিসির গলা কানে এল, “এসব কি লারেলাপ্পা শোনা হইতাসে?” রেডিওর আওয়াজ কিছুটা কমিয়ে দিয়ে কথাটা শুনিনি শুনিনি করে রইলাম| কিছুক্ষণ পার পিসির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, “পোলাডা এক্কেরে অপগন্ড হইসে| বাপে রবিশঙ্করের ছাত্র আর পোলায় শোনে লারেলাপ্পা| দেইখ্যা আয়, তর সোট ভাই কিটু, হেয়ায় ক্যামন মাথা নাড়াইয়া নাড়াইয়া আব্দুল করিম শোনে …|” এরপর আর রেডিও শোনা চলেনা, অতএব বন্ধ করতেই হোল|

তখন আমার সাইজ পাড়ার হুলো বেড়ালটার থেকে খুব একটা বড় ছিলনা| রেডিও রাখার পরেও টেবিল-এ যা জায়গা থাকত তাতে আমি বেশ আরাম করে আসন-কেটে বসে যেতে পারতাম| পিসির ওই বকাটা মন থেকে কিছুতেই যাচ্ছিলনা| ওই গান কিটু শোনে!! তাহলে আমাকেও চেচ্টা করে দেখতে হবে| দুপুর একটা থেকে দেড়টা রেডিওতে খেয়াল ইত্যাদি বাজান হোত| আমিও ওইসময় রেডিও তারস্বরে চালিয়ে টেবিলে বসে মাথা নাড়াতে শুরু করতাম| পিসি কাছাকাছি থাকলে মাথা নাড়ানর গতি তীব্রতর হোত| খুব চাইতাম যে পিসি দেখুক, কিন্তু দেখত বলে মানে হতনা| আমার বেশ কিছুদিন মাথা নাড়িয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাবার পর একদিন দুপুরে পিসি খেতে খেতে বলল, “ইবার ইটারে বাড়ির পোলা মনো হয়| কি যে ছাই-ছাতা শোনন শুরু করসিলি…”

শুরুতে ভালো না লাগলেও শেষমেষ রাগ-তালের নেশাটা লেগেই গেল|